নন্দিত কথাশিল্পী ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ৭০তম জন্মবার্ষিকী আজ। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কীর্তি রেখেছেন শিল্প-সাহিত্যর বেশিরভাগ শাখাতেই। বাংলা সাহিত্য ছাড়াও কর্মক্ষেত্রের যে শাখাতেই তিনি হাত দিয়েছেন, তৈরি করেছেন নতুন ধারা।
একাধারে তিনি সাহিত্য দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন বাংলার মানুষকে। নির্মাণ করেছেন অনন্য সব নাটক, চলচ্চিত্র ও গান। তাঁর হাত ধরেই তারকার সম্মান পেয়েছেন এদেশের অনেক শিল্পী।
নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রমে ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। লেখকের জন্মদিনটি অন্যবছরের মতোই এবারও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ, পড়াশোনার পর্ব শেষ করে ঢাবিতেই খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার ক্যামিস্ট্র্রির উপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতাতেই স্থায়ী হন। পর শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোমাত্রায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।সহজ-সরল গদ্যে জীবনের কথকতা তুলে ধরা তার উপন্যাস এদেশে পাঠক তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে।
হুমায়ুনের সাহিত্যিক জীবনে তার লেখা বেশিরভাগ উপন্যাসই জনপ্রিয়তা পায়। তার প্রতিটি বই পাঠক গ্রহণ করেছে সাদরে। হুমায়ুন আহমেদের তৈরি করেছেন মিসির আলী ও হিমুর মতো অনবদ্য দুই চরিত্র। হিমু সিরিজের বই, মিসির আলী সিরিজের বইসহ শ্রাবণ মেঘের দিন, অপেক্ষা, রূপার পালঙ্ক, লীলাবতী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা জ্যোস্না ও জননীর গল্পসহ অসংখ্য সুপাঠ্য বই তিনি উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য। তার বেশ বড় মাপের অবদান রয়েছে বাংলাদেশের নাট্যজগতে।
এ কারিগর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে নিজের জানান দেন। এরপর তিন শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন।
১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ দর্শকদের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩ সালে নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’।
১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ‘শ্যামল ছায়া’ সিনেমাটি। যা ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
এরপর ২০০৬ সালে মুক্তি পায় ‘৯ নম্বর বিপদ সংকেত’। ২০০৮-এ ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন।
২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুক্তি পায়। যা দেশ-বিদেশে প্রচুর আলোচনায় আসে।
তাঁর চলচ্চিত্রের মৌলিক গানগুলো তিনি নিজেই রচনা করেন, যার বেশিরভাগই পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।
নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও দোসরদের হাতে শহীদ হন। মায়ের নাম আয়েশা ফয়েজ। তার দুই ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব।
জন্মদিনের নানা আয়োজন
হুমায়ূন আহমেদের বাসায় রাত ১২টার পর লেখকের জন্মদিনের কেক কাটেন পরিবারের সদস্যরা। প্রতি বছরের মতো এবারও হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে নুহাশপল্লী সাজানো হয়েছে ভিন্ন সাজে। এ প্রসঙ্গে মেহের আফরোজ শাওন বলেন, মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে স্মরণ করা হবে হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি বেঁচে থাকতে প্রতিবছরই পরিবারের সবাই মিলে তার জন্মদিনে নুহাশপল্লীতে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হতো।
হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সপ্তমবারের মতো হুমায়ূন মেলা। এদিন সকাল ১১টায় হিমুপ্রেমিরা হলুদ পাঞ্জাবী পরে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে উপস্থিত থেকে হলুদ বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করবেন। উপস্থিত থাকবেন হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের সদস্য-সহ বিভিন্ন অঙ্গণের হুমায়ূন ভক্ত ও বিশিষ্টজনরা। উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে পরিবেশিত হবে হুমায়ুন আহমেদের লেখা গান। হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে স্মৃতিকথা বলবেন অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনরা।
নৃত্য পরিবেশন করবে চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ে ও অন্যান্য নৃত্যশিল্পীরা। আরো থাকবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে আবৃত্তি পরিবেশনা। মেলার স্টুলগুলোতে থাকবে হুমায়ুন আহমেদের বই, হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচ্চিত্র ও নাটকের ভিডিও সিডি। স্টুলগুলোতে আরো থাকবে দেশীয় নানান পণ্যসামগ্রী। হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে চিত্রাংকন করবে বিভিন্ন বয়সী শিশুশিল্পীরা। মেলা সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই ও রেডিও ভুমি।
হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আয়োজন করেছে ‘হুমায়ূন সাহিত্যে বাঙালির জীবন ও সমাজ’ শীর্ষক সেমিনার। জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকাল ৫টায় আয়োজিত সেমিনারে সম্মানিত অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন কথাসাহিত্যিক মুম রহমান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন, অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মো. মাজহারুল ইসলাম ও অভিনেতা ডা. এজাজ আহমেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।