প্রিয় রাশেদ,
সম্ভবত, আমার এই লেখাটি তুমি পড়তে পারবেনা। শুধু তুমি নও, তোমার সতীর্থদের যাদের কথাই আমি লিখতে যাচ্ছি- তাদের কেউই হয়তো আমার এই বাক্যগুলোতে অন্তত চোখ বুলিয়ে নেওয়ার সুযোগটুকুও পাবেনা। কেনো পাবেনা সেই প্রশ্ন সময়ের জবাবের জন্য তোলা থাক। তবুও, আজ অন্তত কিছু লিখার জন্য নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে বড্ড তাড়না অনুভব করছি।
তোমাদের একজন স্যার আছেন না? মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল। সেদিন উনাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘মহামতি জাফর স্যার, কোটা আন্দোলনের ‘রাশেদ’ কেনো আপনার বন্ধু নয়?’
দেখো, আমার প্রশ্নটা হয়তো অনেকেই বুঝতে পেরেছে আবার অনেকেই পারেনি। যারা আমার সেদিনকার প্রশ্নটি বুঝতে পারেনি, তাদের জন্য একটু খোলাসা করার চেষ্টা করছি।
আমরা একটা ‘জাফর ইকবালীয়’ বলয়ে বড় হয়েছি। জাফর ইকবাল ছিলেন আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। প্রকৃতি জুড়ে যেমন বায়ুর উপস্থিতি, আমাদের কাছে জাফর ইকবালও ছিলেন সেরকম। এখনকার কিশোররা ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান দেখে দেখে বড় হয়। বিশ্বাস করো- আমরা বড় হয়েছি জাফর ইকবালকে দেখতে দেখতে। জাফর ইকবালকে পড়তে পড়তে। ‘সুপার হিরো’ বলতে যা বোঝায়, এককথায় জাফর ইকবাল আমাদের কাছে ঠিক সেরকম ছিলেন। আমাদের ছোটোবেলাকার স্বপ্ন, কিশোরবেলার ‘নায়ক’ মানুষটা যুবকবেলার ‘খলনায়ক’ বনে যাবেন, সে কথা আমরা কখনো কল্পনাতেও ভাবিনি।
এই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্প, এই গল্প তো আমরা জাফর ইকবালদের মুখ থেকেই শুনেছি। তাঁর তৈরি করা চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এর কথা মনে আছে? রাশেদ নামের সেই কিশোরটার কথা যে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তার সাহসিকতা আমাদের সাহসের পারদকে কতোটা উঁচুতে যে নিয়ে গিয়েছলো তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। চলচ্চিত্রের অন্তিমলগ্নে যখন রাজাকার বাহিনী রাশেদের চোখ বেঁধে তাকে বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে- সেই দৃশ্য দেখে বুকের ভিতরটা হুঁহুঁ করে উঠেছিলো বারংবার। সেই কিশোরবেলায় ভাবতাম,- আহা! যদি আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ হতো! আমিও হয়ে উঠতাম রাশেদ! একটি বিপ্লবী চরিত্র!
যে জাফর ইকবাল কিশোরবেলাতেই আমার মধ্যে বিপ্লবী হয়ে উঠার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে দিতে পারে, সেই জাফর ইকবাল মানুষকে কতোটা প্রভাবিত করতে পারে, ভাবো তো?
কল্পনায় জাফর ইকবাল ‘রাশেদ’ কে এঁকেছেন। তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অধিকারের পক্ষে সংগ্রামী একটি চরিত্রে চিত্রায়িত করেছেন সুদক্ষভাবে। জাফর ইকবালের এই মুন্সিয়ানার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু, তোমাদের মতো বাস্তবের রাশেদরা যখন অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে, সংগ্রাম করতে গিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে, আওয়াজ তুলতে গিয়ে মার খায়, গ্রেফতার হয়, হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়, নির্যাতিত হয়, ঠিক তখন জাফর ইকবালরা কি করে জানো? বিশ্বকাপের গল্প করে।
এই যে নুরুদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে, হাসপাতালে তাদেরকে চিকিৎসা নিতে দিচ্ছেনা, এই যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরিকুলের কথাই ধরো। কি বেড়দক পেটানোটাই না পেটালো ছেলেটাকে। হলুদ গেঞ্জি পরা একটা ছেলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার পায়ের হাঁড় দু’টুকরো করে দিয়েছে। এক্স-রে রিপোর্টে আসা ছবিটা দেখে মনে হচ্ছিলো একটা গাছের শুকনো ডালকে দু’অংশে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। কি অমানবিক, ভাবতে পারো?
এই তরিকুল কি আর কোনদিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে? এই তরিকুল কি আর কোনদিন হেঁটে ক্যাম্পাসে আসতে পারবে? এই তরিকুল আর কোনদিন বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে পারবে? এই তরিকুলকে নিয়ে তার মায়ের যে স্বপ্ন ছিলো, তার কি হবে? তার ছোট্ট বোনের আবদার, তার বাবার দাবি, সেসবের কি হবে?
ঢাবির যে মেয়েটার গায়ে হাত দেওয়া হলো, যে মেয়েটাকে নির্যাতন করা হলো, ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে তার সাথে পশুর মতো আচরণ করা হলো, হলত্যাগ করতে বাধ্য করা- কোনকিছুর কি আদৌ বিচার হবে?
আমাদের জাফর ইকবাল স্যাররা কি এসব দেখেন? তাদের কাছে কি এসব খবর পৌঁছায়?
হ্যাঁ। তাদের কাছে এসব পৌঁছায়। রাশেদ, স্যারের কাছে তোমার সেই চিৎকার ‘আমাকে ডিবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আমাকে বাঁচান’ ঠিকই পৌঁছেছে। মার খেতে খেতে শিক্ষকের পা জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়া নুরুর আর্তচিৎকারও পত্রিকা মারফত তাঁর কাছে চলে গেছে। হাঁতুড়ির আঘাতে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া পায়ের হাঁড় নিয়ে তরিকুলের গোঙানি স্যারের কাছে না পৌঁছাক, তার এক্স-রে রিপোর্টের ভাইরাল ছবিও সম্ভবত তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। স্যারের কাছে পৌঁছেছিলো নির্যাতিতা মেয়েটার কান্নার শব্দ, পায়ের রগ কেটে ফেলা মেয়েটার আর্তনাদ।
কিন্তু জানো রাশেদ, এসবের কোনোকিছুতেই আমাদের স্যারের ঘুম ভাঙেনি। উনার ঘুম ভেঙেছে কিসে জানো? উনার বাসার পাশে অবস্থিত মহিলা হোস্টেলের মেয়েদের ফুটবল দেখার উন্মাদনায়। তারা যখন আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ম্যাচের উত্তেজনাকর সময়গুলোতে গোলের সাথে সাথে ‘গোললললললল’ বলে লাফিয়ে আকাশ-বাতাস এক করে দিচ্ছিলো, সেই চিৎকারে স্যারের ঘুম ভেঙেছে। স্যার এটা নিয়ে কলাম লিখেছেন আজ। শিরোনাম ‘বিশ্বকাপ’।
সেই কলামে আমাদের স্যার ব্যাপকভাবে দেশপ্রেম জাহির করেছেন। কেনো আমাদের দেশে এত্তোগুলো ভিনদেশি পতাকা উড়বে এই ভাবনাটাই এই মুহূর্তেই স্যারের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তোমরা মার খাচ্ছ, জেলে যাচ্ছো, হাঁতুড়ির আঘাতে দু টুকরো হয়ে পড়ছে তোমাদের পায়ের হাঁড়, ভুলুন্ঠিত হচ্ছে বোনদের ইজ্জত-আব্রু। সেই চিৎকার, সেই আর্তনাদে কিন্তু স্যারের ঘুম ভাঙেনি এবং ভাঙেওনা।
ও হ্যাঁ রাশেদ, তোমাদের প্রতি স্যারের ভীষণ দয়া এবং করুণা আছে। জানো সেটা কি? এই যে তোমরা যারা অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছো, তোমাদের কাউকে যদি উনি চাকরির ইন্টারভিউ কক্ষে পান, সেদিন তিনি তোমাদের দেখে তোমাদের গায়ের উপর হড়হড় করে বমি করে দেবেন।
রাশেদ, কি ভাগ্য আমাদের, তাইনা? আমরা এমন একজনকে ভাবতে ভাবতে, দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে বড় হয়েছি যিনি আমাদের দেখলেই হড়হড় করে বমি করে দেবেন। রাশেদ, চলো আমরা শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিগুলো ভুলে যাই। সেই ঘুম পাড়ানি গল্প, সেই আবেগ এবং আবেশের গল্প, সেই মহাকাশের মহাকাল সর্বস্ব কল্পকাহিনীও। আমরা এখন যুবক। আমাদের এখন শত্রু-মিত্র সনাক্ত করতে হবে। এই শত্রুদের চিনিয়ে দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে। আমরা চাইনা আমাদের আগামী প্রজন্মও তাদের শৈশব-কৈশোরে মনের মধ্যে এমন একজনকে লালন করতে করতে বেড়ে উঠুক যে আগাগোড়া একটা দালাল, কপট এবং ভন্ড। শপথ নাও রাশেদ, এই দালালদের আর কখনোই আমরা বন্ধু ভাববো না। এরা আমাদের বন্ধু না।