মিসরের পিরামিড ও ভারতের তাজমহলসহ পৃথিবীতে রয়েছে বহু বিস্ময়কর দর্শনীয় স্থান, যা দেখে পর্যটকমাত্রই বিস্ময়ে অভিভূত হয় । এক কালের মার্কিন ফার্স্টলেডি হিলারি কিনটন তাজমহল দেখে আফসোস করে বলেছিলেন, আহ! আমি যদি এখানে থাকতে পারতাম! কুরআনে কারিমের বিস্ময়কারিতা দুনিয়ার সব বিস্ময়ের ওপরে।
আধুনিক যুগের সবচেয়ে জ্ঞানী ও প্রভাবশালী লোকটি যদি কুরআনের গভীর জগতে পৌঁছতে পারে, তবে অবশ্য মনের অজান্তেই বলবে যে, আহ! যদি আমার জীবন কুরআনের মতো হতো! প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: একবার নাখলা নামক স্থানে ফজর নামাজে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। শত শত বছরের বয়স্ক একদল জিন তা শুনে বলেছিল, আজ আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি (সূরা জিন-০১)।
কুরআন আশ্চর্যজনক তো অবশ্যই! কেননা, কুরআনে কারিম হেদায়াত আর জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে ভরপুর এক অতল মহাসমুদ্রের মতো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীর সমুদয় বৃ যদি কলম হয় এবং এ সমুদ্রের সাথে সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে যদি কালি হয় তবুও তার বাণীগুলো লিখে শেষ করা যাবে না (লুকমান-২৭)। মহানবী সা: বলেন, ‘কুরআনের আশ্চর্য ধরনের বিস্ময়কারিতা কখনো শেষ হবে না, এটি কোনো দিন পুরান হবে না। কুরআনে রয়েছে হেদায়াতের মশাল ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুউচ্চ মিনার’ (তাফসিরে সাঈদী)।
কুরআনের রচনা অনন্য অদ্বিতীয়। এটি অপূর্ব ভাববিজড়িত আশ্চর্য শব্দবিন্যাস ও বহুমাত্রিক চমৎকারিত্বসম্পন্ন বাক্যসংবলিত এক অমূল্য সম্পদ। কুরআন নাজিলের যুগ ছিল সাহিত্যের যুগ। তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকেরা ছিলেন আরবেই। প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ কবিতা ও রচনাকে কাবাঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে গর্ব করা হতো।
আল্লাহ তায়ালা তাদের বলেন, ‘আমার বান্দার প্রতি যা নাজিল করেছি তাতে তোমাদের যদি কোনো সন্দেহ হয় তবে এর মতো ছোট্ট একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো’ (বাকারা-২৩)। যুগশ্রেষ্ঠ ওই সব সাহিত্যিকও কুরআনের সমমানের ছোট্ট একটি সূরা রচনা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। ৭২৭ সাল। ইরানের কিছু পথভ্রষ্ট লোক ল করল যে, দেশের আপামর জনতা কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এ আকর্ষণ থেকে লোকদের ফেরানোর উদ্দেশ্যে কুরআনের অনুরূপ গ্রন্থ রচনার জন্য দেশের প্রতিভাসম্পন্ন, ধীশক্তির অধিকারী ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইবনে মুকাফ্ফাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধার লোভে কাগজ কলম নিয়ে তিনি নিজের গবেষণালয়ে বসে যান। ছয় মাস পর দরজা খুলে দেখা গেল ইবনে মুকাফ্ফা ঘর্মাক্ত দেহে গভীর ধ্যানে মগ্ন। চার পাশে ছেঁড়া কাগজের বড় বড় স্তূপ। তাকে ডেকে অর্পিত কাজের খোঁজ নিলে তিনি বললেন, দেশবাসী! ছয় মাস চলে গেল অথচ আমি কুরআনের অনুরূপ একটি বাক্যও রচনা করতে পারিনি। যতবার চেষ্টা করেছি ততবার ব্যর্থ হয়ে লিখিত কাগজ ছিঁড়ে কাগজের বড় বড় স্তূপ বানাতে পেরেছি। ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে লজ্জিত হয়ে তোমাদের দেয়া এ প্রকল্প ত্যাগ করলাম।
কুরআন তেলাওয়াতের সুর বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত বিস্ময়কর উপহার। মর্মস্পর্শী এর আওয়াজ শ্রোতাকে অবাক করে দেয়। পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থের এ বৈশিষ্ট্য নেই। এর তেলাওয়াতে আকাশ থেকে ফেরেশতা নাজিল হয়। হজরত উসাইদ বিন হুজাইর রা: এক রাতে কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকলে আকাশ থেকে একদল ফেরেশতা অবতরণ করে (বুখারি)।
কুরআন তেলাওয়াত একটি ইবাদত, আর ইবাদতের গতি ঊর্ধ্বমুখী। তাই পৃথিবীর কোনো আওয়াজ আকাশমুখী না হলেও মুসলমানদের কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ আকাশমুখী হয়ে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২১ জুন অ্যাপোলো-১১ তে চড়ে নীল আর্মস্ট্রং, অলড্রিন ও কলিন্স চাঁদে অবতরণ করেন। নিল আর্মস্ট্রং সেখানে বহু আওয়াজ শোনেন এবং তা রেকর্ড করেন।
পৃথিবীতে এসে ওই রেকর্ড প্লে করলে প্রমাণিত হয় যে, তা মুসলমানদের আজান ও নামাজে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ। মিসর সফরে এসে তিনি ওই রূপ আজানের সুর শোনেন এবং তাতে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণীতে রয়েছে বিস্ময়কর বাস্তবতা। স্বয়ং কুরআনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘আমি এই উপদেশগ্রন্থ নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক’ (হিজর-৯)। এটি নাজিল থেকে ১৪শ’ বছর পার হয়ে গেল অথচ কুরআনের একটি বর্ণও হারিয়ে বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়নি। সংরণপদ্ধতির একটি এটিও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন। তাই কোনো ধর্মগ্রন্থের হাফেজ না থাকলেও এক জরিপ মতে, পৃথিবীতে কুরআনের হাফেজের সংখ্যা ছয় কোটির ওপরে।
সূরা হিজরের ৯ নম্বর আয়াতের প্রতি দুঃসাহসী চ্যালেঞ্জ করেছিল তুরস্কের একদল অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও ক্যাপটেন। তারা সাগরে একটি জাহাজে অর্ধনগ্ন নর্তকীদের দ্বারা আনন্দ কনসার্টের আয়োজন করে এবং ওই আয়াত সংবলিত পৃষ্ঠা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নর্তকীদের পায়ের নিচে ছিটিয়ে দেয়। সাথে সাথে আল্লাহর গজব নেমে আসে এবং কুরআনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে এমন একজন ছাড়া বাকি সবাই ধ্বংস হয়।
সূরা ইউসূফের ৯২ নম্বর আয়াতে ফেরাউনের লাশ অত রাখার ঘোষণা এসেছে। সে অনুযায়ী ১৮৯৮ সালে লাশটি আবিষ্কার হয়ে অদ্যাবধি অত অবস্থায় রয়েছে। সূরা রূমের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কয়েক (১০) বছরের মধ্যেই পারস্যের উপর রূমের বিজয় হবে। আর ঠিকই ১০ বছরের মধ্যে পারস্যের ওপর রূমের বিজয় হয়। এ ছাড়াও আরো অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, যা যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয়েছে ।
কুরআনের গাণিতিক বিস্ময়কারিতা আরো চমকপ্রদ। বিসমিল্লাহতে ১৯টি বর্ণ আছে। এ ১৯ সংখ্যাটি দ্বারা কুরআনের বিভিন্ন শব্দ বা বর্ণের যোগফলকে ভাগ করলে নিঃশেষে বিভাজ্য হবে। যেমন ‘ইসিম’ শব্দটি কুরআনে এসেছে ১৯ বার। এখন ১৯/১৯=১ অর্থাৎ নিঃশেষে বিভাজ্য। ‘আল্লাহ’ এসেছে ২৬৯৮ বার। ২৬৯৮/১৯=১৪২। ‘রাহমান’ শব্দ এসেছে ৫৭ বার।
৫৭/১৯=৩। ‘রাহিম’ শব্দটি এসেছে ১১৪ বার। ১১৪/১৯=৬। সূরা নূনে ‘নূন’ বর্ণটি এসেছে ১৩৩ বার। ১৩৩/১৯=৭। সূরা ক্বফে ‘ক্বফ’ বর্ণটি এসেছে ৫৭ বার, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। সূরা আরাফে ‘আলিফ লাম মিম সোয়াদ’ এ বিচ্ছিন্ন হরফগুলো ওই সূরায় যতবার এসেছে এর সমষ্টি ৫৩২০, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য।
আবার কুরআনে এমন কিছু শব্দ আছে যা একটির বিপরীতে অন্য আরেকটি শব্দ সমভাবে বিদ্যমান। পুরুষ বা রিজাল শব্দ এসেছে ২৪ বার, বিপরীতে নারী বা ইমরাহ শব্দটিও এসেছে ২৪ বার। জীবন বা হায়াত শব্দটি ১৪৫ বার, বিপরীতে মৃত্যু বা মউত শব্দটিও এসেছে ১৪৫ বার। দুনিয়া শব্দটি ১১৫ বার, বিপরীতে আখিরাত শব্দটিও ১১৫ বার। ফিরিশতা শব্দটি ৮৮ বার, বিপরীতে শয়তান শব্দটিও ৮৮ বার। ১২ মাসে এক বছর। তাই শাহর বা মাস শব্দটিও এসেছে ১২ বার। ৩৬৫ দিনে এক বছর। তাই দিন বা ইয়াউম শব্দটিও এসেছে ৩৬৫ বার। এ ছাড়া কুরআনে আরো অনেক সংখ্যাতথ্য রয়েছে।
কুরআনে রয়েছে চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য। আধুনিক বিজ্ঞান বলেছে যে, জীব সৃষ্টির মূল হচ্ছে ‘পানি’। অথচ ১৪ শ’ বছর আগেই কুরআন বলেছে, ‘আর প্রাণবন্ত সব কিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করেছি’ (আম্বিয়া-৩০)। বিজ্ঞান বলেছে, সৃষ্ট বস্তুর সব কিছুতে জোড়া জোড়া পদ্ধতি রয়েছে।
অথচ ১৪ শ’ বছর আগেই কুরআনের সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে তা বলা হয়েছে। গর্ভধানী বাতাসের তথ্য উল্লেখ আছে সূরা হিজরের ২২ নম্বর আয়াতে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তথ্য উল্লেখ আছে সূরা মুরসালাতের ২৫ ও ২৬ নম্বর আয়াতে। পাহাড়গুলো যে পৃথিবীর পেরেক তা উল্লেখ আছে সূরা নাবার ৭ নম্বর আয়াতে। একসময় আকাশ ও পৃথিবী একসাথে থাকার তথ্য রয়েছে সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াতে।
এ ছাড়া কুরআনে আরো প্রচুর পরিমাণে চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে, যার সাথে আধুনিক বিজ্ঞান মিলে যায়। সুতরাং কুরআন হলো সব নীতিমালার মূলনীতিগ্রন্থ যাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এটিকে ‘ENCYCLOPAEDIA OF KNOWLEDGE’ Ges ‘ALL IN ONE’ও বলা যায়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘নিউ ইস্ট’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘কুরআন হচ্ছে অতি বিস্ময়কর এক গ্রন্থ।’ আসলে এটি মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। দরকার শুধু দেখার মতো চোখ, শোনার মতো কান ও বোঝার মতো মন।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ সা: এ কিতাবের মাধ্যমে এমন এক কাক্সিত সমাজ সৃষ্টি করেছিলেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয়। তিনি সা: বলেছেন, ‘আমার যুগই শ্রেষ্ঠ যুগ’ (মুয়াত্তা)। সে সমাজে রাতের গভীরে কোনো নষ্টা নারী কোনো মুসলিম যুবককে ডাকলে যুবক বলত, ‘না, আমি একজন মুসলিম। আমি আল্লাহকে ভয় করি’।
মদ নিষিদ্ধ করা হলে দেশের সব জনগণ যার যার মদের মটকা রোডে নিয়ে ঢেলে দেয় ও মটকা ভেঙে ফেলে। কোনো লোক অপরাধ করলে নিজেই এসে আত্মসমর্পণ করত। সামাজিক অপরাধের পরিমাণ শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল। হজরত ওমর রা: এক বছর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির আসনে অবস্থান করে বলেন, এ এক বছরে একটি মামলাও আমার আদালতে কেউ দায়ের করেনি।
পরিশেষে বলা যায়, টাইটানিক জাহাজ যখন ডুবছিল তখন ক্যাপটেন পিএস এলিয়ট এ বিপদ থেকে মুক্তির ল্েয চিৎকার করে বলছিল, PRAY FOR US NOW, WE ARE AT THE TIME OF OUR DETH। আজকের মানবজাতিও যেন মদ, জুয়া, গুম, খুন, চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, অত্যাচার, অবিচার ও স্বৈরাচারের বিপদ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাঁচার আর্তনাদ করছে।
তাদের উদ্ধারে কে এগিয়ে যাবে? হ্যাঁ, কুরআনধারী মুসলিম জাতি তথা মুসলিম যুবকদেরই এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, তারাই সর্বোত্তম জাতি ও সর্বোত্তম উদ্ধারকর্মী। নিমজ্জমান এ জাতির সামনে কুরআন নামের এ শক্ত রশিটি ধরে বলতে হবে, মুক্তি পেতে হলে- ‘তোমরা আল্লাহর রশিকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত করে ধরো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা’ (ইমরান-১০৩)।