শেষ হলো নিজামীপর্বের। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করেন সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা।
ফাঁসি কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন: ঢাকা জেলা প্রশাসক (ম্যাজিস্ট্রেট) সালাউদ্দিন আহমেদ, সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা, ডিএমপির পক্ষে ডিসি ডিবি উত্তর শেখ নাজমুল আলম, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, ডিসি লালবাগ মফিজ উদ্দিন।
ঘড়ির কাঁটা যখন ১২টা বেজে ০১মিনিট তখন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির তার হাতে ধরা রুমালটি ফেলে দেন। আর তখনই যম টুপি ও গলায় দড়ি পরিহিত নিজামীর পায়ের নিচ থেকে পাটাতন সরিয়ে ফেলেন জল্লাদ। সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা মৃত্যু নিশ্চিত করে ডেথ সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করেন।
এর আগে ফাঁসির বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা চলে সন্ধ্যা থেকেই। পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো নিজামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
রীতি অনুযায়ী কারাগার মসজিদের ইমামকে সাথে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। এরপর ইমাম আসামিকে তওবা পড়ান। ফাঁসি কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগেই আসামিকে গোসল ও ইচ্ছানুযায়ী খাবার দেয়া হয়।
নিজামী হলেন পঞ্চম মানবতাবিরোধী অপরাধী যার সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হলো। একই সঙ্গে তিনি প্রথম কোনো দলীয় প্রধান একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের জন্য ফাঁসিতে ঝুলে যার দণ্ড কার্যকর হলো।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর চারদলীয় জোট সরকারের আমলের মন্ত্রী নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালে এর মধ্যে আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এরমধ্যে চার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড ও দুটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
পরে এ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান নিজামী। ৫ মে ওই আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত; যার মধ্য দিয়ে তার দণ্ড কার্যকরে আইনি বাধা কাটে। সোমবার বিকেলে রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে রায় পৌঁছে যায় কারাগারে।
নিয়ম অনুযায়ী বদরপ্রধান নিজামীর সামনে এরপর খোলা ছিল কেবল নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। তবে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় নিজামীর দণ্ড কার্যকর হয় মঙ্গলবার দিবাগত রাতে।
নিজামীর ফাঁসি ঘিরে রাতভর রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেবেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা।
বাড়তি নিরাপত্তায় পাবনায়
মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সাঁথিয়াসহ জেলার সব জায়গায় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
পাবনা-রাজশাহী এবং পাবনা-ঢাকাসহ সব মহ্সড়কে বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অাইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সব ধরনের যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিদ্দিকুর রহমান খান জানান, যদি আজ রাতেই রায় কার্যকর হয় এবং এই বিষয়টিকে কন্দ্রে করে যেকোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মতো পরিবেশ নস্যাৎ করা হবে। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য অাইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
তিনি আরো জানান, নিজামীর দাফন যদি তার নিজ এলাকাতে করা হয় তাহলে সেখানেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো ধরনের নাশকতা করার বা বিশৃঙ্খখলা করার চেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে।
পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তোড়জোড়ের মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে নিজামীর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে তিনটি গাড়িতে নিজামীর পরিবারের সদস্যরা কারা ফটকে পৌঁছান। প্রায় দেড় ঘণ্টা কারাগারের ভেতরে অবস্থান করার পর ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে চলে যান তারা।
কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজামীর ভাতিজি সাংবাদিকদের বলেন, তার চাচা বলেছেন, আমি শক্ত আছি, তোমরাও শক্ত থাকো।
প্রাণভিক্ষা চাইলেন না নিজামী
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নিজামীকে দিয়ে পঞ্চমজনের দণ্ড কার্যকর হলো। এরমধ্যে দুজন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার শেষ সুযোগটি নিয়েছিলেন। তারা হলেন- সাবেক মন্ত্রী জামায়াতের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। তবে তারা কেউ-ই রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পাননি।
নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর তার সামনে খোলা ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ। তবে ওই সুযোগ নিজামী নেননি। সোমবারই নিজামীর আইনজীবী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না নিজামী। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতির মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, প্রাণ ভিক্ষা চাননি নিজামী।
নিজামীর জন্ম থেকে মৃত্যু
গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসেবে ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আসা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে।
স্থানীয় বোয়ালমারি মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করা নিজামী কামিল পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। মাদ্রাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজামী ১৯৬১ সালে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন।
পাঠকের মতামত: