এতিমদের হক নষ্ট করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ট্যানারি মালিকদের এখানে হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তাই এই পদ্ধতি থেকে বের হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটি না হলে এতিমরা বরাবরই ঠকবে। সানবিডির সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (টিএবি) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ।
তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমরা লবণযুক্ত চামড়া ক্রয় করি এবং সেটির দাম সরকার থেকে নির্ধারণ করেছে। আমরাও ওই দামে চামড়া কিনবো। সরকার নির্ধারিত মূল্যের কম দামে যদি আমরা কিনি তাহলে বলতে পারবেন আমরা এতিমদের হক নষ্ট করছি, তার আগে নয়। এখানে যারা দু-চারদিনের জন্য ব্যবসা করতে আসে তারা কিন্তু একটি ব্যবসা নিয়ে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এখানে বড় একটি অংশ মাদ্রাসা ও এতিমখানার। আমিও মনে করি যে, এটি এতিমদের হক। এটি সরাসরি এতিমখানায় দিয়ে দেয়া উচিত। তাহলে চামড়াটি তাদের (ছাত্রদের) মাধ্যমে লবণ দিয়ে সরাসরি আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারে এবং সঠিক দাম পায়। আমাদের অনেক মালিক মাদ্রাসাতে গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এখানে যারাই পশু কুরবানি দেয়, আল্লাহর উদ্দেশ্যে দেয়, চামড়াও এতিমদের দিয়ে দেন। তাহলে তারা এটি সংরক্ষণ করতে পারবে এবং সঠিক দাম পাবে। কিন্তু সরবরাহ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক বছরই মধ্যস্বত্বভোগীরাই হস্তক্ষেপ করে এবং বিনিয়োগ করে। তারা কিন্তু খুব কম দামেই চামড়া কিনেছে।’
শাহীন আহমেদ বলেন, ঈদের তিনদিন পর পর্যন্ত যে কাঁচা চামড়া আসছে, সেই চামড়ার বিশাল একটি সরবরাহ হয়েছে। তবে লবণযুক্ত চামড়া ঈদের ১০ থেকে ১৫ দিন পরে ক্রয় শুরু হয়। এটি প্রতি বছরই হয়। আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের ক্রয় শুরু হবে। সুতরাং এখানে ট্যানারি মালিকদের দোষ দেয়ার সুযোগ নেই।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, যারা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী, তারা যদি চামড়াকে সঠিকভাবে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেন, তাহলে সেটি দুই-তিন মাস পর্যন্ত ভালো রাখা সম্ভব। এ সময়ের মধ্যে আমাদের ট্যানারির মালিকরা সেগুলো ন্যায্য দাম দিয়ে কিনে নেবে। যুগযুগ ধরে এভাবে চলে আসছে। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণ না দিয়ে যদি রাতারাতি চামড়া বিক্রি করতে চায় তাহলে তারা সঠিক দাম পাবে না বলেও তিনি বলেন।
দাম না পেয়ে চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে ফেলার বিষয়ে টিবিএ চেয়ারম্যান বলেন, এগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটি উদাহরণ দেয়ার মতো নয়। দাম তো কম ছিলো না। ঈদের দিনও সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে ৭শ থেকে ৮শ টাকায় চামড়া বিক্রি হয়েছে। এই দর তো ঠিক আছে। কারণ ২০০ টাকা লবণের খরচ আছে। আর ১০০ টাকা মুনাফা।
চামড়া পাচারের শঙ্কার কথা জানিয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, প্রত্যেক বছরই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চামড়া পাচার হয়। এ বছর প্রচার করা হয়েছে চামড়ার দাম দুইশ বা তিনশ টাকা, সেটি সত্য নয়। এতে পাচারের শঙ্কা আরও বেড়েছে। তাই সীমান্ত রক্ষীবাহিনী যেন আরও অন্তত একমাস কড়াকড়ি আরোপ করেন। যাতে চামড়ার কোনো ট্রাক যেন সীমান্তমুখী না হয়।
ট্যানারির মলিকরা অতি মুনাফা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি চামড়া থেকে একশ টাকা মুনাফা করতে না পারলে কি করবে। গড়ে একটি চামড়া ২০ ফুট হলে ৪০ টাকা করে হলে আটশ টাকা দাম হয়। এখানে তাদের পরিশ্রম আছে, লবণ দিতে হবে, তারপর ব্যবসা। এখান থেকে আমরা ক্রয় করে আবার প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবসা করি। তাহলে এটি অতি মুনাফার লক্ষণ হয় কীভাবে।
ব্যবসা ভালো না তাই চামড়ার দাম কমছে, অথচ চামড়া পণ্যের দাম বাড়ছেন এ বিষয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, জুতা যারা তৈরি করে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করলে দাম একটু বেশি হবেই। কারণ ব্যবসায়ীরা ১০০ আইটেম তৈরি করে, ৭০টি বাজার পায়, বাকি ৩০টি আইটেম গুদামে পরে থাকে। সেটির গড় করতে হয়। ফলে চামড়া পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে এই পদ্ধতি।
চামড়া শিল্পের ভবিষ্যতের বিষয়ে টিএবি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক ছোট। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের এখানে সস্তায় রাবার বা পিভিসি পাওয়া যায়। ফলে চামড়ার চেয়ে এর ব্যবহার বেশি। আমাদের বিদেশি অনেক পার্টি গুণগতমান ও পরিবেশের কারণে চলে গেছে। এর ফলে আমাদের রপ্তানি দিন দিন কমছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার ২০২১ সালে পাঁচ বিলিয়ন ডলার চামড়া রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলো। এটি আদৌ পূরণ সম্ভব হবে না। এটি নিয়ে অবশ্যই আমরা শঙ্কিত। আমরা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক দশমিক থ্রি বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটি এক দশমিক শূন্য পাঁচে নেমেছে। সুতরাং প্রবৃদ্ধি বাড়ার কথা থাকলেও সেটি না হয়ে আরও কমছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামীতে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। এটি বাড়াতে হলে অনেক ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলোর মধ্যে হলো চামড়া নিয়ে একটি নীতিমালা ঠিক করা, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক ঋণ সহজ করা, ইএফ ফান্ডের মতো একটি ফান্ড চালু করলে এই খাতটি সামনে এগিয়ে যাবে। সরকারের টার্গেটও পূরণ হবে।
ট্যানারি মলিকরা অর্থ সংকটে ভুগছে জানিয়ে তিনি বলেন, আর্থিকভাবে আমরা সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি। স্থানান্তরিত ট্যানারিতে আমরা এখনো উপযুক্তভাবে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। যে কারণে এ শিল্পে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। বিসিক এখনো আমাদের উপযুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দিতে পারেনি। যে কারণে এ শিল্প ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অর্থের অভাবের কারণে ১৫০টি ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৪০টি পুরোপুরি উৎপাদনে গেছে। আর কোনো মতে গেছে, এমন ১১৩টি। বাকিগুলো এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি।
সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পুরো চামড়া শিল্পে সাতশ বা আটশ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এটি কিন্তু অনেক বেশি না। যেখানে একটি কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। ২০১৭ সালে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করার কারণে আমরা ব্যবসা হারিয়ে ফেলেছি। অনেক মালিক কারখানা চালু করার চেষ্টা করেও পুঁজির অভাবে করতে পারে না। যারা উৎপাদনে যেতে পারেনি তারা ব্যাংক ঋণও পায়নি বা রিশিডিউলও করেনি। এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শিল্পের স্বার্থে এগুলোর দিকে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন।
একটি সিন্ডিকেট করে দাম কমানো হচ্ছেন এমন প্রশ্নে শাহীন আহমেদ বলেন, এটি পুরোপুরি মিথ্যা কথা। কারণ হলো আমরা এখনো চামড়া কিনাই শুরু করিনি। আগে শুরু করি। পরে দেখা যাবে।
সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এখনো প্রস্তুত হয়নি। তাহলে কি হাজারীবাগের মতো সেখানেও পরিবেশ বিপর্যয় হবেন এ বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে সিইটিপি অপারেশনালাইজড করার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় এটি আগামী চার মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। এটি ঠিক হয়ে গেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে একটি সমস্যা হলো সলিটেস্ট ম্যানেজমেন্ট। এটি প্রত্যেক দিন যা উৎপন্ন হয়, সেটি ম্যানেজের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে একটি খোলা ডাম্পিং-এ পুকুরের মতো করে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান না হলে পরিবেশ দূষণ আরও বাড়বে। তবে সিইটিপি ২৪ ঘণ্টা চললে পরিবেশ বিপর্যয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।